করোনাকালে চীন-ভারত সামরিক সংঘাত

  • আপডেট টাইম : July 05 2020, 16:17
  • 846 বার পঠিত
করোনাকালে চীন-ভারত সামরিক সংঘাত

মোঃ মোস্তফা মিয়া



চীন এবং ভারত দুটো দেশই বিপুল অস্ত্রসম্ভার রয়েছে এবং এসব অস্ত্রশস্ত্র বেশ আধুনিক। গত ২০ বছর ধরে দুটি দেশ শুধু নিজেরাই সমরাস্ত্র তৈরি করেনি, একই সঙ্গে অস্ত্র আমদানিও করেছে। বিশেষ করে ভারত পরপর পাঁচ বছর বিশ্বের সবচাইতে বেশি অস্ত্র আমদানিকারক দেশের স্থান দখল করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইসরায়েল থেকে তারা অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্র এনেছে। তারা নিজেরাও বিদেশি প্রযুক্তি এনে নিজেরা অস্ত্র তৈরি করেছে। একইভাবে চীন রাশিয়া থেকে কিছু অস্ত্র কিনেছে, কিন্তু বেশিরভাগ অস্ত্র তারা এখন নিজেরা উৎপাদন করে । অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র তৈরীতে চীন বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এক্ষেত্রে ভারত চীন থেকে অনেক ক্ষেত্রে পিচিয়ে।চীন ও ভারতের মধ্যে সামরিক সংঘাতের একটা ঐতিহাসিক পেক্ষাপট রয়েছে এবং করোনাকালের সীমান্ত সামরিক সংঘাতেও তার একটা বিরাট প্রভাব রয়েছে।
চীন-ভারতের মধ্যে ১৯৬২ সালে যুদ্ধ সংঘটিত হয় । সীমানা নিয়ে বিরোধ থেকে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত পরাজিত হয়। চীন তিব্বত দখল করার পর ভারতের বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীনকে চীনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলে দাবী করে, এভাবে যে সীমান্ত সমস্যার শুরু হয় তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সূচনা করে। যুদ্ধে চীনজয়ী হয়ে একতরফা যুদ্ধবিরতি জারি করে, আকসাই চীন দখলে রাখে কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ ফিরিয়ে দেয়, যুদ্ধের পর ভারত সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই যুদ্ধের পরে ভারত তার পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য ভারতকে সমর্থন করে, অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে মিত্রতা বাড়াতে সচেষ্ট হয় |
চীন এবং ভারতের সীমারেখা যা নেপাল, সিক্কিম , অরুণাচল প্রদেশ এবং ভূটান দ্বারা তিন ভাগে বিভক্ত। এই সীমার দৈর্ঘ্য মায়ানমার থেকে ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তান পর্যন্ত। এই সীমারেখায় কিছু অমীমাংসিত অঞ্চল রয়েছে– পশ্চিমে আকসাই চীন, যা সুইজারল্যান্ড এর সমান এক অঞ্চল এবং এখানে চীনের সিয়াংকিং এবং তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সদর রয়েছে (তিব্বত ১৯৬৫ সালে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা লাভ করে), পূর্বে ভূটান এবং মায়ানমার এবং মধ্যে অরুণাচল প্রদেশ এর একাংশ। দুটি অঞ্চলই চীন ১৯৬২ সালে দখল করেছিল। অরুণাচল প্রদেশ এর পশ্চিম সিয়াং জেলার একাংশ মেচুকা উপত্যকা দখল করেছিল।
যুদ্ধ অধিকাংশ সময়েই অতি উচ্চতায় অবস্থিত স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। আক্সাই চিন ৫,০০০ মিটার উচ্চতায় এক সল্ট প্লেটের মরুভূমি। অরুণাচল প্রদেশে ৭০০০ মিটারেরও অধিক উচ্চতায় কয়েকটি শৃংগ আছে। চীনা সেনারা অঞ্চলটির এক বৃহৎ স্থান দখল করে নিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালীয় ক্যাম্পেইনের মতো এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই বহু সৈনিক শত্রুর আক্রমণের পরিবর্তে পরিবেশের প্রতিকূলতার জন্যে মৃত্যুমুখে পতিত হয় যুদ্ধের মূল কারণ ছিল আক্সাই চিন এবং অরুণাচলের সার্বভৌমত্ব নিয়ে পারস্পরিক বিবাদ। ভারতের কাশ্মীর অংশের দাবী করা এবং চীনের ছিঞ্ছিয়াঙ অংশের দাবী করা অক্সাই চিনের মধ্যে তিব্বত এবং ছিঞ্ছিয়াং কে সংযোগীকারী একটি পথ আছে। চীন এই পথ নির্মাণ করার প্রয়াস চালালে যুদ্ধের আরম্ভ হয় বলে মনে করা হয়।
যুদ্ধের পূর্বে ভারত চীনের প্রতি অতিরিক্ত সহানুভূতি মনোভাব নিয়ে চলতো। জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে চীনের স্থায়ী সদস্য পদ নিয়ে ভারত তার সমর্থন করে। ভারত কখনো ভাবেনি যে চীন কোনোদিন ভারতে হামলা করতে পারে। যার জন্য পরবর্তীতে পন্ডিত জহরলাল নেহেরু অনেক আক্ষেপ করেন।ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান কোদানদেরা সুবাইয়া থিমাইয়া চীনকে পাকিস্তানের থেকেও বড় প্রতিপক্ষ মনে করতেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সাথে তার মতপার্থক্যের কারণ সেটা বাস্তব রূপ নেয়নি।
এরই ধারাবাহিকতায় চীন ও ভারদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সীমান্ত উত্তেজনা পরিলক্ষিত হতে থাকে। বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবত ভারত ও চীনের মধ্যেকার সীমান্তে দুদেশের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা চলছে। উভয় দেশের মাঝে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন জায়গায় বিরোধ এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে এবং মাঝে-মধ্যেই সেটি মাথা চাড়া দেয়। চীন, ভুটান আর ভারতের সিকিম প্রদেশের সংযোগস্থলে একটি উপত্যকার ভেতর দিয়ে রাস্তা তৈরি করাকে কেন্দ্র করে নতুন বিরোধের সূচনা।
চীন চায় সেখানে একটি রাস্তা তৈরি করতে। কিন্তু যে জায়গাটিতে চীন রাস্তা তৈরি করতে চাইছে সেটি ভুটান ও চীনের মধ্যকার একটি বিরোধপূর্ণ এলাকা। সে উপত্যকাকে চীন এবং ভুটান-উভয় দেশই দাবী করে। এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ভুটানের পক্ষে। ভারত মনে করে, চীন যদি এ রাস্তাটি তৈরি করে তাহলে কৌশলগতভাবে ভারত পিছিয়ে পড়বে। এ রাস্তাটির মাধ্যমে চীন এমন একটি জায়গায় পৌঁছে যাবে যেটি ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। চীন এমন জায়গায় সড়ক নির্মাণ করতে চাইছে যার পাশেই ভারতের ২০ কিলোমিটার চওড়া একটি করিডোর আছে। এ করিডোরের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো মূল ভারতের সাথে সংযোগ রক্ষা করে। উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে উভয় দেশ সীমান্তে তাদের সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে এবং একটি মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে সড়ক নির্মাণ না করার জন্য ভুটানের তরফ থেকে চীনকে আহবান জানানো হয়েছে।
ভুটান বলছে, এ ধরনের সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে চীন আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন করছে। ভারত মনে করে সিকিম রাজ্যটি তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সিকিম অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভারত চীনের যে কোন আগ্রাসনের জবাব দিতে পারে। চীন এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে বলেই সেখানে তাদের কৌশলগত অবস্থান জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত পরাজিত হয়েছিল। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি সম্প্রতি বলেছেন, ১৯৬২ সালের ভারত এবং ২০১৭ সালের ভারত এক নয়। নিজের ভূখণ্ড রক্ষার জন্য ভারত এখন যথেষ্ট শক্তিশালী বলে মন্তব্য করেছেন মি: জেটলি।
অন্যদিকে চীন মনে করে যে জায়গাটিতে তারা সড়ক নির্মাণ করতে চাইছে সেটি তাদের অবিচ্ছেদ্য ভূখণ্ড। ভারতে সেখানে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে করে চীন। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের কথা ভারতকে মনে করিয়ে দিচ্ছে চীন। দেশটি বলছে চীন আগের তুলনায় এখন আরো বেশি শক্তিশালী। চীনের সাথে ভারতের উত্তেজনার আরেকটি কারণ রয়েছে। তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামা ভারতে বসবাস করছেন, যেটি চীন মোটেও পছন্দ করছে না।
করোনাকালেও চলমান সপ্তাহে পারস্পারিক সীমান্ত বিরোধী নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে গেল চীন এবং ভারত। লাদাখ সীমান্তে সোমবার রাতের ঘটনায় নিজেদের এক কর্নেলসহ ২০ সেনা নিহতের কথা স্বীকার করেছে ভারতের সেনাবাহিনী। অন্যদিকে চীনের সেনারাও হতাহত হয়েছেন বলে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদক এমন ইঙ্গিত দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু এখনো বলা হয়নি।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহমুদ আলি বিবিসি বাংলাকে বলেন, চীন এবং ভারত দুটি দেশই গত বছর দশেক ধরে তাদের সীমান্ত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। চীন এটা করেছে তিব্বতে। আর ভারত করেছে দক্ষিণের অরুণাচল প্রদেশে এবং লাদাখ অঞ্চলে।দুটি দেশই এসব জায়গায় রাস্তাঘাট করেছে, বিমান ঘাঁটি বানিয়েছে। রাডার স্টেশন বসিয়েছে। সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি করেছে। দু’পক্ষই বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে।
এছাড়া সেখানে সামরিক মহড়াও দিয়েছে দুই দেশ। কাজেই একটা যুদ্ধংদেহী মনোভাব সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেখা যাচ্ছে।
এর পাশাপাশি চীন এবং ভারত দুই দেশেই জাতীয়তাবাদী একটি মনোভাব জোরালো হয়ে উঠেছে। দুটি দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো দেখলে, বিশেষ করে ভারতে, এটা বেশ চোখে পড়বে। সেখানে চীনকে একটি বৈরি দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে অনেক কথা বলা হচ্ছে।
চীনের সংবাদমাধ্যমগুলোতে অবশ্য ভারত অতটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু তারপরও যখনই ভারত সম্পর্কে কথা উঠছে, সেখানে জাতীয়তাবাদী একটা মনোভাব বেশ স্পষ্ট। সুতরাং এটা বলা যায়, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে যে বৈশ্বিক মেরুকরণ, সেখানে চীন এবং ভারতের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। দুই দেশেই একটা জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা বা চিন্তাধারা বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে। যেসব সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী সামনাসামনি মোতায়েন আছে, সেখানে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। কাজেই সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল।
দুটি দেশেরই স্বার্থ হচ্ছে যুদ্ধে না জড়ানো। কারণ যুদ্ধ হলে ক্ষয়ক্ষতি বেশ ব্যাপক হবে। দুটি দেশেরই ক্ষতি হবে। কাজেই দুই দেশই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাইছে। চীন এবং ভারত উভয়েরই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। দুই দেশের সংঘাতে যদি ক্রমবর্ধমান হারে ভয়ংকর সমরাস্ত্রের ব্যবহার হতে থাকে, দুই দেশই আসলে পরস্পরকে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
ড. মাহমুদ আলি বলেন, আমার ধারণা কোন দেশই সেরকম ব্যাপকতর কোনো সংঘাতে জড়াতে চায় না। কারণ শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধের ফল কী দাঁড়াবে সেটা কেউই এখন পর্যন্ত বলতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ভারত এবং চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখন ব্যাপক আকার নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী একটা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে কোনো দেশই এরকম একটা সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ করতে চাইবে না। তৃতীয়ত, যুদ্ধ যদি খুব বেশি ছড়িয়ে পড়ে, সেটা যে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে সেটা দুপক্ষই বোঝেন। কারণ দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। কাজেই তাদের চেষ্টা থাকবে উত্তেজনা কমিয়ে আনার।

অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান চায়না পলিসি সেন্টারের পরিচালক অ্যাডাম নি আল–জাজিরাকে বলেন, বর্তমান এই উত্তেজক পরিস্থিতি এমনকি পাতানো হতে পারে। উভয় দেশই অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে জর্জরিত। ফলে উভয়েই শান্তি বজায় রাখতে আগ্রহী। বেইজিংয়ের সামনে বর্তমানে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে হংকং, জিনজিয়াং ও করোনা–পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের মতো উল্লেখযোগ্য। রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মতো বিষয়। ফলে আরেকটি যুদ্ধে জড়ানোর কোনো কারণ নেই বেইজিংয়ের দিক থেকে।
১৯৯০–এর পর থেকে উভয় দেশ পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়। এতে উভয় পক্ষই উপকৃত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে বাণিজ্যের পরিমাণ ৯ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি। এতে অবশ্য ভারত এখনো বাণিজ্য ঘাটতিতে রয়েছে। আর এটিই ভারতের অনেক বড় অস্বস্তির কারণ। এই অস্বস্তি থেকেই গত মাসে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার চীনা বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধ আরোপ করে, যাকে ‘বৈষম্যমূলক’ হিসেবে বর্ণনা করে চীন। উপরন্তু, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্পর্ক দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টিকেও ভালো চোখে দেখছে না চীন। এদিকে ভারতের সম্প্রসারণবাদী মনোভাবে অসন্তুষ্ট নেপাল। আর ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নিয়ে বরাবরই অস্বস্তিতে রয়েছে। এই সবই এখন একসঙ্গে কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

তবে ভারতের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ মনে করছেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলাসহ আগে–পরের নানা ধরনের ব্যর্থতা ঢাকতে নরেন্দ্র মোদি সরকারের এমন একটি সীমান্ত উত্তেজনার এই মুহূর্তে ভীষণ রকম দরকার। ঠিক একই রকমভাবে এ ধরনের মহামারি পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চীনও চায় নিজের অভীষ্ট অর্জন করতে। বিশেষত হংকংয়ে যে নিরাপত্তা আইন বেইজিং শেষ পর্যন্ত করিয়ে নিয়েছে, তা এমন পরিস্থিতি না থাকলে সম্ভব হতো না বলে মনে করা হচ্ছে। আর এটিই সীমান্তে এ ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি উভয় পক্ষের পাতানো কি না, সে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
ভারত-চীন মিলে বর্তমানে ২৭৫ কোটি মানুষের বাস। বিশ্ব জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যেকোনো বৈরিতায় লিপ্ত থাকা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য খুবই খারাপ নজির হবে। বিপুল আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ রয়েছে এই দুই দেশে। আবার উভয় দেশের হাতে রয়েছে অন্তত ৪০০ পারমাণবিক অস্ত্রের বিশাল মজুত।
এ রকম অবস্থায় আলোচনাই একমাত্র সহনীয় পথ। ভারত এখনো আলোচনার ওপরই বেশি জোর দিচ্ছে। পরিস্থিতির পরবর্তী অধ্যায় তাই অনেকখানি নির্ভর করছে চীনের মনোভাবের ওপর। চীনের দিক থেকে সীমিত শক্তি প্রদর্শনের ইচ্ছা পরিতৃপ্ত হয়ে থাকলে এই যুদ্ধংদেহী অবস্থা থিতিয়ে আসবে বলেই মনে হয়। ইতিমধ্যে আটক ভারতীয় সৈন্যদের অক্ষত ফেরত দিয়ে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যে বার্তা দিলেন, তা ইতিবাচক। লাদাখের আবহাওয়াও এমন বৈরী যে চীন ও ভারত কোনো পক্ষই সেখানে দীর্ঘ সময় উত্তেজনা জিইয়ে রাখার কৌশল নেবে বলে মনে হয় না। তবে যখনই যে মাত্রায় পরিস্থিতি শান্ত হবে, মোদি সরকারকে একতরফা সামরিক ক্ষয়ক্ষতির জন্য দেশের বিরোধী দলগুলোর কাছে মোটাদাগে জবাবদিহি করতে হতে পারে এবার।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম মোদি সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোণঠাসা অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে। জোরেশোরে চীনা পণ্য বর্জনের আওয়াজ তোলা হচ্ছে দুরূহ ওই অবস্থা এড়ানোর কৌশল হিসেবেই। ভারতজুড়ে এ সপ্তাহে বিজেপির অঙ্গসংগঠনগুলো পালা করে চীনের পতাকা পোড়াচ্ছে এবং চীনা পণ্যের বিজ্ঞাপন মুছে চলেছে। তবে পাল্টা শক্তি প্রদর্শনের বিকল্পও নয়াদিল্লি একেবারে বাদ দিয়েছে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। রাজনৈতিক অস্তিত্ব ঝুঁকিতে পড়লে সেটাও ঘটে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ হবে, স্রেফ সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে।
ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় উগ্রসাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভক্ষির কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে।এরই ধারাবাহিকথায় চীন এই অঞ্চলে একক অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়।ইতিমধ্যে চীনের পক্ষ থেকে ভারতকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, ভারত যেন চীনকে পাকিস্তান না ভাবে। উভয় দেশের মধ্যে করোনাকালে সীমান্তে যে সামরিক সংঘাত সংঘটিত তার মূলে রয়েছে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ।
এই স্বার্থ সমূহ সুরক্ষা ও টেকসই করণে চীনের প্রধান প্রতিপক্ষ ভারত আর ভারেতের প্রধান প্রতিপক্ষ চীন। এই ক্ষেত্রে চীন বেটিং ও বলিং উভয় ক্ষেত্রে ভারতকে প্রচন্ড মানসিক চাপে রাখতে শতভাগ সফল হয়েছে। পারমানবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে বড় ধরণের সামরিক সংঘাত না হলেও চীন তার সীমান্ত এলাকাসহ ভূরাজনৈতিক কৌশলে ভারতকে আবদ্ধ করে ফেলেছে-এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
আরেকটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় চীনের উপস্থিতি একান্ত আবশ্যক। এই অঞ্চলে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতের উচিত উগ্র-সাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং বিগ-ভ্রাদার নীতি পরিহার করে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত করা। বিশ্বায়নের যুগে সামরিক সংঘাত দিয়ে এবং একলাচলা নীতি দিয়ে সীমান্ত সমস্যা সমাধান করা যাবে না। সীমান্ত সমস্যাসহ সকল সমস্যা দৃঢ়ভাবে সমাধানের জন্য পারস্পারিক সোহার্দপূর্ণ সহযোগীতা ও আলোচনা আবশ্যক।

লেখকঃ অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট।

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
July 2020
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
0Shares