মোঃ মোস্তফা মিয়া
ফাহমিদা হোসেন লুমা। ফাহমিদা লুমা নামেই লেখালেখির জগতে পরিচিত। তিনি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা তজম্মুল হোসেন একজন সুনামধন্য আইনজীবী। মা লুৎফা হোসেন চৌধুরী ছিলেন একজন গৃহিণী। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করে দীর্ঘদিন থেকে ব্যাংকিং পেশায় যুক্ত আছেন। স্বামী চৌধুরী নিশাতুর রহমান কোরেশী সরকারি কর্মকর্তা। কন্যা চৌধুরী জাইমা কোরাইশী প্রাইমারিতে অধ্যয়নরত।
জন্মস্থান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটে তাই কবিতায় বারবার উঠে আসে প্রকৃতির অসাধারণ দৃশ্যের বর্ণনা। ব্যক্তিজীবনে প্রাপ্তি আর সফলতার আনন্দের পাশাপাশি অকালে প্রিয়জনদের হারানোর অনুভূতি লেখায় নিয়ে এসেছে গভীর জীবনবোধ।
বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে নিয়মিত লিখেন। বিভিন্ন সংকলন, ম্যাগাজিন, জাতীয় দৈনিকগুলোতে নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হলেও একক বই হিসেবে এটি প্রথম বই। অবসরে ভালোবাসেন বই পড়তে, বাগান করতে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে ঘুরে বেড়াতে এবং অপূর্ব দৃশ্যগুলো ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে।
উল্লেখ্য যে, কবি ফাহমিদা লুমার পরিবার হলো লেখক বান্ধব পরিবার। তার স্বামী সমকালীন বিভিন্ন প্রসঙ্গসহ নিয়মিত কবিতা লিখে থাকেন। স্বামীর বড় ভাই ব্যাংকার চৌধুরী শেফাকুর রহমান কোরেশীও কবিতাসহ সমকালীন বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে লেখালেখি করে থাকেন। ইতিমধ্যে তার একটি বড় আকারের বইও প্রকাশ করা হয়েছে।
কলকাতা বইমেলা-২০২০, বিগত ২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। মেলায় কলকাতার “উতল হাওয়া পাবলিশার্স” কর্তৃক প্রকাশিত ফাহমিদা লুমা কর্তৃক সংকলনকৃত কবিতা “অনুভবে ভালোবাসা” গ্রন্থটি থাকছে। কবিতার সংকলনটির আনুষ্ঠানিক ভাবে মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে ৪ ফেব্রুয়ারি। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন গুণীজন এবং কবিগণ উপস্থিত ছিলেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর রাজত্ব যেহেতু কলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো সেহেতু অধিকাংশ সাহিত্য ছিলো পশ্চিম বাংলা কেন্দ্রিক। বরাবরই সাহিত্য প্রকাশে তাদের ভূমিকা ছিল মূখ্য। পূর্ব বাংলার কবি ও সাহিত্যিকদের লেখা তাদের প্রকাশনা জগতে গণহারে স্থান পায়নি। তার মধ্যেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবি ও সাহিত্যিকদের লেখা কবিতা, গল্প ও উপন্যাস কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকথায় কবি ফাহমিদা লুমার লেখা বিভিন্ন কবিতা নিয়ে “অনুভবে ভালোবাসা” নামে কবিতার বইটি প্রকাশিত হয় এবং কলকাতা বই মেলায় তা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। তাও আবার কবির নিজ উদ্যোগে তা প্রকাশ পায় নাই, প্রকাশনার নিজ উদ্যোগ ও যোগাযোগের মাধ্যমে কবিতা সমূহ বই আকারে প্রকাশিত হয়।
সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে কখনও এপার বাংলা ওপার বাংলা আলাদা বিভাজন মনে হয় না। উভয় বাংলায় এক-অপরকে সাহিত্যচর্চায় এবং বিভিন্ন প্রকাশনায় সার্বিক সহযোগীতা করে যাচ্ছেন। সাহিত্যচর্চায় উভয় অংশে নিরন্তর উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকথায় কবি ফাহমিদা লুমার “অনুভবে ভালোবাসা” বইটি কলকাতার “উতল হাওয়া পাবলিশার্স” প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
“অনুভবে ভালোবাসা” কবিতার বইটিতে ৪৫টি কবিতা স্থান পেয়েছে এবং বইটি প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাঠকের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। সমকালিন কবিতার জগতে মহাকাশের বিশাল সা¤্রাজ্য এবং নক্ষত্রমন্ডলী নিয়ে গবেষনাধর্মী কবিতা খুব একটা প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হয় না। এখানেই কবির কবিতা লেখার আলাদা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠ্য এবং তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাকাশের ক্যানভাসের অনেক রহস্য প্রকাশিত হয়েছে।
প্রতিটি কবিতায় গ্রাম বাংলার সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, পাখ-পাখালি, ফুল-ফলে ভরা আমাদের বসুন্ধরার বর্ণনাসহ তথা বিশ্বভূমন্ডলের প্রাকৃতিক এবং সামাজিক পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়াবলী ভিন্ন ভিন্ন রুপে, ভিন্ন ভিন্ন উপমার মাধ্যমে অত্যান্ত সুনিপন ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। ফুলজ, বনজ, জলজ রাজ্যের পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ ও গাছগাছালির বর্ণনা কবিতার প্রতিটা ছন্দে ফুটে উঠেছে।
প্রকৃতি রাজ্যের বর্ণার সাথে মানবিক গুণাবলী, মানবিক আকুতি এবং ভালোবাসার অদৃশ্য জগতের অপ্রকাশিত অভিসার, আবেগ, অনুভূতি এবং মানব-মানবীর মনোজগতের অনেক কৌতুহল পূর্ণ বিষয়াবলী ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন ভঙ্গিমায় কবিতার ছন্দে ছন্দে স্থান পেয়েছে।
মহাবিশ্বের দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ, শুকতারা, সন্ধা তারা, নীহারীকা, মায়াবী ছায়াপথ ও তারকা রাজ্যের বর্ণনার সাথে মেঘ রাজ্যের বর্ণনা যেমন কবিতার ছন্দে প্রকাশিত হয়েছে তেমনি হাওর-বাওড়ের বিভিন্ন প্রজাতির পরিবেশবান্ধব জলজ উদ্ভিদ এর বর্ণনার পাশাপাশি জীববৈচিত্র এবং প্রাণীর আবাসস্থল-আশ্রয়স্থলের বিষয়টিও কবিতার ছন্দে ছন্দে স্থান পেয়েছে।
ভালোবাসার স¤্রাজের ইতিহাস আলোচনা করলেই প্রথমে চলে আসে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল এবং প্রজাতির কথা। ফুল এবং প্রজাপতি বাদদিয়ে ভালোবাসার সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ভালোবাসার অব্যক্ত বাসনা ও অনুভূতি সমূহ ব্যক্ত করা যায় না। এই বিষয়টিও কবি ফাহমিদার কবিতায় কবিতার ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
মানবজীবনের ভালোবাসার সমাধি নির্মাণেস্বপ্নময় কল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। এই কল্পময় জগতকে প্রেমের বিভিন্ন উপমায় প্রকাশ করা হয়। প্রেমের এই কল্পময় জগত রহস্যময়। একে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও উপমা দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না। প্রেমের এই রহস্যময় আবেগ সমূহ কেবল ভূক্তভোগীদের ক্ষেত্রে অনুভূত সত্য।
প্রেমময় অনুভূতি সমূহ দিয়ে যেমন গৌরবের ইতিহাস সমৃদ্ধ করা যায় তেমনি পরাজয়ের ইতিহাসও রচিত হয়। জয়-পরাজয়ের পথে যেমন হাসির উত্থান হয় তেমনি পরাজয়ের কান্নার শব্দও তৈরি হয়। এরমধ্যে দিয়ে ইতিহাসের পরিবর্তন হয় এবং পথের বাঁকেই কাহিনী অমর হয়ে রয়। এই পথেই পথিক একদিকে ফিরে পায় জীবনের শেষ ঠিকানা, আবার অন্যদিকে খুঁজে নিতে হয় জীবনের শেষ আবাসস্থল।
নদী, পানি ও জীবন এক অপরের পরিপূরক এবং পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। নদী, সাগর, মহাসাগরের জোয়ার-ভাটা আর মানবজীবনের জোয়ার-ভাটার দৃশ্যত প্রাপ্যতা, হারানোর ব্যদনা, নবজীবনের সূচনা, জীবনের ইতিটানার ঘটনা প্রবাহ কবিতায় সুন্দর ভাবে কবিতার ভাষায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
দুইটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ হিসেবে খ্যাত সিলেটের চা-বাগান সমূহের প্রাকৃতির সৌন্দের্য্যরে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী, চা-বাগানের সবুজ পাতার মায়াবী সৌন্দর্য, অপূর্ব কারুকার্য, বিভিন্ন সভায়, আড্ডায় চা-পানের গুনাবলী, ভালোবাসার পরম ছুঁয়া ইত্যাদি কবি তার নিজস্ব ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।
রূপের বৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের দেশে প্রতি দুই মাস পর পর আসে- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ঋতু। ঋতু বৈচিত্র্যে এ দেশ কখনও আলো ঝলমল, কখনও অঝর ধারা বৃষ্টিতে ঝাপসা দূরের মাঠ, আবার কখনও স্বচ্ছ আকাশ থেকে ঝরে পড়ে রুপালী জ্যোৎ¯œা। অপরুপ প্রকৃতির এই দেশকে তাই বলা হয় রুপসী বাংলা। বাংলার এই অপরূপের বর্ণনা এবং বাঙ্গালী জাতি সত্ত্বার আবেগ, অনুভূতি, আশা-আকাঙ্খা, আনন্দ-ব্যদনা, মায়াবী ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয় গুলো কবি ফাহমিদা লুমা তার কবিতার প্রতিটি শব্দে, বাক্যে, ছন্দে-ছন্দে সুনিপন ভাষায় উপস্থাপন করেছেন-যা পাঠকদের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হবেন।
“অনুভবে ভালোবাসা” কবিতার বইটি শুধু মানব-মানবীর আবেগীয় প্রেম কাহিনী নিয়ে লেখা হয় নাই। মহান সৃষ্টি কর্তা পরম মমতায়, পরম ভালোবাসায় এবং পরম নান্দুনিকতার সাথে অতি যত্নসহকারে বিশ্বজগত এবং জগতের প্রতিটি প্রাণী সর্বোত্তম কৌশলের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃষ্টিতে কোথাও কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় না। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হচ্ছে মানব-মানবী। এই মানব-মানবীর ভালোবাসার মূল স্তম্ভ হলো বিশ্বাস। যাকে কেন্দ্র করে পরিবারের ভিত্তি রচিত হয়। তাই পরিবারকে মানব সভ্যতার প্রথম ভিত্তি ও পাঠশালা বলা হয়।
পরিবারের মাধ্যমে সভ্যতার খেলাফতের দ্বারা ¯্রষ্ঠা কর্তৃক টেকসই ভাবে সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিটি স্তরে পরম ভালোবাসা ও মমতার পরম স্পর্শ অনুভূত হয়। মহান সৃষ্টি কর্তা তার মহা প্রেম, ভালোবাসা, দয়া, মায়া, করুণা ও মমতা থেকে কিঞ্চিত পরিমানে তাঁর সৃষ্টিকে দান করেছেন। যা আমরা মহাসাগরের বিশাল পানি রাশির সাথে এক চা-চামস পানির তুলনা করতে পারি। যার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বব্যবস্থা ও মানব সভ্যতা ঠিকে আছে। যে দিন এই পরম মমতা নিঃশেষ হয়ে যাবে সে দিনই সম্ভবত সব কিছু ধ্বংশ হয়ে যাবে। তাই ভালোবাসা ও বিশ্বাস পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। “অনুভবে ভালোবাসা” কবিতার মূলভাব হচ্ছে তাই।
বিশ্বভূমন্ডল ও মহাকাশ মন্ডলের সৃষ্টি রহস্য, মানব সভ্যতার উত্থান-পতন, জয়-পরাজয়, গ্রীক সভ্যতাসহ বিশ্ব সভ্যতার প্রাকৃতিক এবং মানবিক সা¤্রাজ্যের বহু বিষয় বিভিন্ন কবিতায় বিভিন্ন রুপে, উপমায় প্রকাশ পেয়েছে। মানব সভ্যতার প্রথম সম্মানী ব্যক্তি আদম আঃ থেকে নূহ আঃ পর্যন্ত এবং পরবর্তী মানব সভ্যতাসহ সমকালীন বিশ্ব সভ্যতার এবং বিশ্ব ভূমন্ডলের গবেষনালদ্ধ বিভিন্ন কাহিনী, ¯্রষ্ঠা ও সৃষ্টির অপূর্ব ভালোবাসার নিদর্শন ইত্যাদি কবি তার কবিতায়, কবির ভাষায় সার্থকভাবে যে প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
সমকালীন অনেক কবিদের থেকে তিনি তার কবিতায় নিজেকে স্বতন্ত্র্যভাবে প্রকাশ করেছেন। বাঙ্গালীর নিজস্ব জাতি সত্ত্বার আলোকে বাংলা সাহিত্যের কবিতার জগতে “অনুভবে ভালোবাসা” বইটি গবেষনার উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
কবিতার শব্দ ও বাক্য চয়নে এবং কবিতার ছন্দ মিলানোর ক্ষেত্রে কবির নিজস্ব স্বকীয়তার ভঙ্গিতে কবির মনোজগতের ভিশন, মিশন অত্যন্ত চমৎকারভাবে সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন-যা সহজেই সার্বজনীনভাবে পাঠকদের হৃদয় জয় করতে পারবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি তার কবিতার বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।
আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদের দুই বাংলার মিলিত উদ্যোগ বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে নিয়ে যাবে এক অনন্য উচ্চতায়, দারুণ উৎকর্ষতায়। এর মাধ্যমে দুই বাংলার মধ্যে সাহিত্য ও সাংস্কৃতির বন্ধন হবে সুদৃঢ়। ভাবের আদান-প্রদান হবে টেকসই।
লেখকঃ অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট ।