এম,এ,রউফ
সম্প্রতি সময়ে দেখা যাচ্ছে দেশের কয়েকটি স্বাস্থ্য সেবা নামধারী প্রতিষ্ঠান করোনা চিকিৎসার নামে বিভিন্ন ধরনের ভুয়া টেস্ট রিপোর্টের মাধ্যমে জনগণকে প্রতারিত করছে। আবার অনেকে রোগীদের নিকট অনেক বেশি অর্থ আদায় করছে। ফলে স্বাস্থ্য সেবা প্রত্যাশীদের মনে ক্ষোভ যেমন বাড়ছে, তেমনি সরকারকেও বিব্রত হতে হচ্ছে। এ কারণে এ বিষয়ে আমাদের আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন
সিলেট জেলা ও মহানগরের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত করতে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত সকল চিকিৎসক, টেকনিশিয়ানরা প্রকৃত সনদদারী কিনা এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে ও অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান, ভুয়া ডাক্তার, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ানদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে সিলেটের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
১৫ জুলাই, বুধবার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বরাবরে চিঠি প্রেরণ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
অনুসন্ধানে তথ্য সূত্র থেকে জানা যায়,
সিলেটে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে ক্লিনিক ও হাসপাতাল। ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলছে গলাকাটা রমরমা ব্যবসা। এসব হাসপাতাল ক্লিনিকের অধিকাংশই নির্ধারিত শর্ত মেনে চলছে না। তাদের সেবার মান নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। এ নিয়ে প্রায়ই সময় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেবা গ্রহণকারীদের ঝগড়া হয়। ঘটে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও।
ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর কারণে প্রায় সময় ভাংচুরও করা হয় বিভিন্ন ক্লিনিক হাসপাতাল। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে প্রয়োজনীয় নীতিমালা না মেনেই ক্লিনিক গড়ে উঠছে নগরীর অলিগলিতেও। নিয়ম অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় কোনো ক্লিনিক হাসপাতাল গড়ে উঠতে পারে না। এক্ষেত্রে সিলেটে বিরাজ করছে উল্টো চিত্র।
সিলেট অঞ্চলে ৮৩৯টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে অর্ধেকের বেশিই নিবন্ধন নেই রয়েছে অসংখ্য অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার করছে গলা কাটা ব্যবসা। বেশ কিছু ক্লিনিক রয়েছে বিভিন্ন আবাসিক এলাকায়। যার যার ইচ্ছেমতো ক্লিনিক গড়ে তুললেও স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে। নগরীর স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক নিয়মিত প্রশাসনের মনিটরিং কোনোরকম জবাবদিহিতা ছাড়াই প্রাইভেট ক্লিনিক ল্যাবরেটরিগুলোর ব্যবসা চলছে। নগরীর অধিকাংশ ক্লিনিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয় ও আয়া নেই। বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট তো আছেই। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নিজস্ব চিকিৎসক না থাকলেও রোগী ভর্তি করা হচ্ছে এসব ক্লিনিকে।
বাইরে থেকে চিকিৎসক নিয়ে সেবা দেয়া হয় রোগীর। এতে রোগীকে গুনতে হয় বাড়তি অর্থ। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বিভিন্ন ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
এছাড়া নগরীতে গড়ে ওঠা কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাও এসব ক্লিনিকে গিয়ে রোগী দেখেন। হাসপাতাল ও ক্লিনিকের পাশাপাশি নগরীর যত্রতত্র গড়ে উঠেছে প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নগরীতে গড়ে উঠেছে দালাল সিন্ডিকেট। যারা সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে রোগীদের নিয়ে যায় ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিক হাসপাতালে। তেমনিভাবে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য দালালরা রোগীদের নিয়ে যায় প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। বিনিময়ে দালালরা রোগী প্রতি নির্ধারিত হারে কমিশন পেয়ে থাকে। বিভিন্ন পরীক্ষার কমিশন পেয়ে থাকেন চিকিৎসকরাও। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক রোগীকে কোনো জায়গায় পরীক্ষা করাতে হবে তাও বলে দেন। ফলে বাধ্য হয়ে চিকিৎসকের পছন্দের প্যাথলজিক্যাল ল্যাব বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করাতে হয়। এসব পরীক্ষার ফি তুলনামূলকভাবে বেশি নিলেও সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য তাদের উপযুক্ত-আধুনিক সরঞ্জাম নেই। নেই দক্ষ টেকনিশিয়ানও।
১৯৮২ সালের মে মাসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস ও ক্লিনিক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনের অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ওই অধ্যাদেশে মেডিকেল কনসালটেন্সির জন্য ফি নির্দিষ্ট করে দেয়াসহ ক্লিনিকগুলো কোনো ধরনের অপারেশনের জন্য কত টাকা নেবে এবং ল্যাবরেটরি ফি বেঁধে দেয়া হয়। এমনকি অধ্যাদেশের সাত নম্বর অনুচ্ছেদে বাধ্যতামূলকভাবে যেসব চার্জ ও ফি সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের চেম্বার ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরিতে ডিসপ্লে করার বিধান আরোপ করা হয়। ওই অধ্যাদেশে প্রাইভেট ক্লিনিক স্থাপনের লাইসেন্স পেতে ৭টি শর্ত আরোপ করা হয়। এতে যথাযথ স্থানসহ রোগীর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, প্রত্যেক রোগীর সিটের জন্য ৮ বর্গফুট জায়গা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অপারেশন থিয়েটার, জীবন রক্ষাকারী ও অত্যাবশ্য ওষুধের পর্যন্ত সরবরাহ এবং রোগীর অপারেশনে ট্রিটমেন্ট ও তত্ত্বাবধানের জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় ৩৬ ধরনের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এবং প্রতি ১০ বেডের জন্য একজন করে সার্বক্ষণিক রেজিস্টার্ড মেডিক্যাল প্রাকটিশনার ২ জন নার্স এবং ১ জন সুইপার নিয়োগ বাধ্যতামূলক।
কিন্তু সিলেট নগরীর ক্লিনিক হাসপাতালগুলোতে বিধিমোতাবেক জনবল নেই। অধিকাংশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালই জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
সিলেটে বৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অসংখ্য অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির মাধ্যমে সিলেটে চলছে ফ্রি স্টাইলে রমরমা ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিক ব্যবসা। আর এসব দেখভাল করেন বিভিন্ন সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারদের একটি সিন্ডকেট চক্র। সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের শর্তাবলী কাগজে বাস্তবায়ন দেখিয়ে ক্লিনিকগুলো অনুমোদন লাভ করে। এরপর থেকেই এসব শর্ত ভুলে শুরু হয় গলাকাটা ব্যবসা। বর্তমানে সিলেট নগরীতে এমন অবৈধ ক্লিনিক রয়েছে অসংখ্য। এসব ক্লিনিকের অধিকাংশে নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও নার্স। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা ক্লিনিকে প্রাইভেট রোগী দেখায় ব্যস্ত থাকেন। নার্স সংকট থাকায় বেশির ভাগ ক্লিনিকে আয়া, ওয়ার্ড বয় দিয়ে নার্সের কাজ করানো হয়।
ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো হলো- আম্বরখানায় অবস্থিত হাইটেক মেডিকেল সার্ভিস, আলীয়া মাঠ সংলগ্ন ল্যাব ডেল্টা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রিকাবিবাজার এলাকায় নিউ ম্যাডি হেলথ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ইউনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এদিকে গেল বৎসর সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফুল আলম অভিযান পরিচালনায় রমরমা ব্যবসার জালিয়াতি বের হয়ে আসে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট দিয়ে প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করা, যার ‘মনগড়া’ মেডিকেল রিপোর্ট রোগীদের সঙ্গে এমন ভয়ঙ্কর প্রতারণার এই অভিযানে নেতৃত্ব দেনকারী সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফুল আলম বলেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির রিএজেন্টের মেয়াদ শেষ হয়েছে মার্চে।তবুও তারা চালিয়ে যাচ্ছে
তারপরও প্যাথলজি টেস্ট চালানো হচ্ছিলো। এতে করে ভুল রিপোর্টে রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। সেইসঙ্গে লাইসেন্স না থাকার পরও প্রতিষ্ঠানটি বিদেশগমনেচ্ছুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ চালিয়ে আসছিলো। আশরাফুল আলম বলেন, লাইসেন্স না থাকা বা রেজিস্টার্ড না থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের প্যাথলজি পরীক্ষার যন্ত্রাংশ ঠিক না থাকা। এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ভুল পরীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে ওষুধ খেয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। ফলে আইনে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও তাৎক্ষণিক ১ লাখ টাকা জরিমানা আদায়ক্রমে মামলার নিষ্পত্তি করা হয়।এরপর এখনো পর্যন্ত সিলেটের ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে উল্লেখ যোগ্য কোন অভিযান চালানো হয়নি।এতে করে সিলেটের স্বাস্থ্য সেবা দিনদিন মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ছে।