সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের খাদ্য ও রক্ষীদের রেশনে দুর্নীতি

  • আপডেট টাইম : September 23 2020, 06:44
  • 750 বার পঠিত
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের খাদ্য ও রক্ষীদের রেশনে দুর্নীতি

সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের খাদ্য ও রক্ষীদের রেশন নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নির্ধারিত খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বন্দিরা। তাদের বরাদ্দের ৩ ভাগের ১ ভাগ সরবরাহ করা হয়।

বাকি ২ ভাগ গোপনে কারাগারের বাইরে বিক্রি করা হয়। শুধু তাই নয়, কারারক্ষীদের রেশনের পরিবর্তে যে নগদ অর্থ দেয়া হয় সেখানেও পদে পদে অনিয়ম। চাল, ডাল, চিনি, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের প্রকৃত দামের অর্ধেক টাকা পান রক্ষীরা।

এসব ঘটনার নেপথ্যে জেল সুপার আবদুল জলিলের নেতৃত্বাধীন একটি সিন্ডিকেট প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ ও হতাশা। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোমবার কারাগারে পরিদর্শনে আসা জেলা প্রশাসকের সামনে ওই চাপা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটান এক বন্দি। এদিন জেল সুপারের শরীরে মানববিষ্ঠা নিক্ষেপ করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান ওই বন্দি।

তার নাম শফিকুল ইসলাম জাবেদ। এ ঘটনার রেশ ধরে সন্ধ্যার পর জাবেদকে নিরাপত্তা সেলের ভেতরে বেদম প্রহার করে মনফর নামের এক কারারক্ষী। সারা রাত তাকে উলঙ্গ করেও রাখা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাবেদের সেলে দায়িত্ব পালনরত একজন কারারক্ষী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জাবেদের অভিযোগ- জেল সুপার আবদুল জলিল তাকে বুদ্ধি দিয়ে কারাগারে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার স্বীকারোক্তি নিয়েছেন।

হত্যার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলে জাবেদ দাবি করেছেন। জেল সুপার তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ঘটনার স্বীকারোক্তি দিলে যতদিন কারাগারে থাকবেন ততদিন নিরাপত্তা সেলের যে কক্ষে তিনি বন্দি আছেন, সেখানে একটা টিভি দেয়া হবে।

এমনকি আইনি সহায়তা দিয়ে জেল থেকে মুক্তি ছাড়াও ভালো ভালো খাবার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তাকে। জাবেদের অভিযোগ, টিভি দেয়াতো দূরের কথা কারা বিধি অনুযায়ী ঠিকমতো খাবারও দেয়া হয় না তাকে।

কম খাবার পরিবেশনের অভিযোগ শুধু জাবেদের নয়, সব বন্দির। এরপরই ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার জেল ভিজিটের অপেক্ষায় ছিলেন এ জাবেদ।

জানা যায়, সোমবার সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে যান সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম। জেল ভিজিটের খবর পেয়ে পূর্বপ্রস্তুতি নেন জাবেদ। একটি সেভেন-আপের বোতলে মানববিষ্ঠা গুলিয়ে নিজের কাছে সংরক্ষণে রাখেন।

দুপুর ১২টার দিকে জেল সুপার জেলা প্রশাসককে নিয়ে ওই সেলের সামনে গিয়ে এ বন্দির সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। ওই সময় হঠাৎ ওই বোতলের ময়লা জেল সুপারের শরীরে ছুড়ে মারেন।

এ সময় লজ্জায় জেলা প্রশাসক জেল সুপার আবদুল জলিলের উদ্দেশে বলেন, ‘এভাবেই জেলখানা পরিচালনা করেন আপনারা?’

একথা বলেই দ্রুত জেলখানা থেকে বেরিয়ে যান ডিসি। ক্ষুব্ধ জেলা প্রশাসক জেল কর্তৃপক্ষের কোনো আপ্যায়নই গ্রহণ করেননি। এমনকি সেখানে তিনি এক গ্লাস পানিও খাননি।

জানতে চাইলে সিলেট জেলা প্রশাসক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে সোমবার রাতে টেলিফোনে বলেন, ‘ওই বন্দি আসলে মানসিক বিকারগ্রস্ত- এমনটি আমাকে জানানো হয়েছে। বিষয়টি আমি দেখব।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সীমানার বাইরে জেল সুপার আবদুল জলিলের ছোট ভাই আবদুল কাদের বাদশার নামে একটি জমি পাওয়া গেছে।

ঝিনাইদহের গ্রামের বাড়ি থেকে সিলেটের বাঁধাঘাটে ধুপনীখোলা মৌজায় সাড়ে তিন শতক জমি কেনার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর সিলেট সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে এ দলিল সম্পাদন হয়।

২ লাখ ১০ হাজার টাকায় সিলেট সিটি কর্পোরেশন আওতাধীন উত্তর বাগবাড়ীর হাজী মো. শফিক মিয়ার কাছ থেকে এ জমি কিনে নেন তিনি। কিন্তু এ জমির পেছনে একটি লেনদেনের হিসাব রয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

তারা জানান, আবদুল জলিল সমাজসেবা অফিসার হিসেবে প্রথম চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর ২০১০ সালে বিসিএস তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবেও তার চাকরি হয়।

সমাজসেবা অফিসার হিসেবে এক সময় তিনি গাজীপুর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় কারারক্ষীদের সঙ্গে তার একটা সংযোগ হয়।

তাদের কাছ থেকে জেল সুপারদের আয়ের একটা ধারণা পান তিনি। সেই ধারণা থেকেই তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে জেল সুপার পদে যোগ দেন আবদুল জলিল।

জেল সুপার পদে যোগদানের পর তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের পাল্লা ভারি হতে থাকে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সোমবারই সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এ বদলি করা হয় তাকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেল কোড অনুযায়ী একেকজন বন্দিকে দুপুর ও রাতে দুই বেলায় ৪৯৫ গ্রাম ভাত দেয়ার কথা। সকালের নাস্তার জন্য এক বেলায় আটা বরাদ্দ ৮৭ দশমিক ৪৮ গ্রাম।

প্রত্যেকের জন্য মাছ বা মাংস বরাদ্দ ৩৬ দশমিক ৪৫ গ্রাম। প্রতি একজনের জন্য ডাল ১৪৫ গ্রাম, সবজি ২৯১ গ্রাম, তেল ২০ দশমিক ৫ গ্রাম, লবণ ২৯ দশমিক ১৬ গ্রাম, আলু ১১৬ দশমিক ৬৪ গ্রাম।

সিলেট কারাগারে বন্দির সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৪০০। সরকারিভাবে এ খাবার যদি বন্দিদের সরবরাহ করা হয় তাহলে কি পরিমাণ বরাদ্দ কারা অভ্যন্তরে প্রতিদিন আসার কথা তারও একটি হিসাব পাওয়া গেছে।

সেই অনুযায়ী, ২ হাজার ৪শ’ বন্দির জন্য ৪৯৫ গ্রাম হিসাবে ১১শ’ ৮৮ কেজি চাল, ২১৪ কেজি আটা, মাছ অথবা মাংস ৮৯ কেজি, ডাল ৩৫৫ কেজি, ৭১২ কেজি সবজি, ৫০ কেজি রান্নার তেল, ৭১ কেজি লবণ, ২৮৫ কেজি আলু দেয়ার কথা প্রতিদিন।

কিন্তু একজন বন্দি যে খাবার পাওয়ার কথা তার ৩ ভাগের ১ ভাগ সরবরাহ করা হয়। অন্য ২ ভাগ কারাগারের বাইরে বিক্রি করে দেয়া হয়। মূলত সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে পার্ট ২-এর দায়িত্বে আছেন আবদুল জলিল।

পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন পার্ট ১-এরও। গত ৩ বছরে এ দুই কারাগার থেকেই বন্দিদের খাবারের অংশ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই সিন্ডিকেট।

এদিকে কারারক্ষীরাও শান্তিতে নেই সিলেটে। কারারক্ষীদের রেশনের চাল-ডাল বিক্রির একটি অংশও হাতিয়ে নেয় সেই সিন্ডিকেট। একাধিক কারারক্ষী জানান, পুরনো কারাগারে একটি বড় পুকুর আছে।

ওই পুকুরের মাছ বন্দিদের পেটে যায় না। মাছ চাষ করেন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা। সেগুলো বিক্রি করে মাসে ৫০ হাজার টাকা নেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। এ পুকুরের দেখভালের দায়িত্বে আছেন প্রধান কারারক্ষী মো. নুরুল ইসলাম।

নতুন কারাগারে স্থানান্তরের পর পুরাতন কারাগারে গ্যাসলাইন বিচ্ছিন্ন রয়েছে। অথচ কাগজে-কলমে সেখানে ঠিকাদাররা জ্বালানি সরবরাহ করেন।

বাস্তবে জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই গাছ কেটে তা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জ্বালানি সরবরাহের পুরো টাকাই ভাগ-বাটোয়ারা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কারারক্ষীদের রেশন থেকে কিভাবে জেল সুপারের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট টাকা আয় করে এর একটি বিশদ বর্ণনা পাওয়া গেছে।

একজন কারারক্ষী এ প্রসঙ্গে বলেন, অবিবাহিত কারারক্ষী প্রতি মাসে ১১ কেজি চাল, ১২ কেজি গম, সাড়ে ৩ কেজি ডাল, আড়াই কেজি তেল ও পৌনে ২ কেজি চিনি পাওয়ার কথা।

কিন্তু এ রেশন তারা পান না। কারারক্ষীদের বলা হয়, চাল-ডাল ভালো না। কিনে খান। নামকাওয়াস্তে অবিবাহিত কারারক্ষীদের রেশন বিক্রির নগদ অর্থ ধরিয়ে দেয়া হয়।

ওই সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকে কারারক্ষীদের বলা হয়, রেশনের প্রতি কেজি চালের বাজার মূল্য ৩৬ টাকা, গম ২৬ টাকা, ডাল ১শ’ টাকা, তেল ১শ’ টাকা এবং চিনি ১শ’ টাকা।

কিন্তু বাস্তবে যে টাকা দেয়া হয় তা হচ্ছে- প্রতি কেজি চাল ১৮ টাকা, গম ১৬ টাকা, ডাল ৭০ টাকা এবং চিনি ৪০ টাকা। এ রেশন যিনি বণ্টন করেন তাকে সবাই ‘লাইস’ নামে ডাকেন।

এখন এ লাইসের দায়িত্বে আছেন লিটন। তিনি জেল সুপারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ৪ বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

এছাড়া জেল সুপারের ওই সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে আছেন কারারক্ষী আবদুল মতিন, বাহার, মনফর ও কিবরিয়া।

উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জেল সুপার আবদুল জলিল মঙ্গলবার টেলিফোনে বলেন, বন্দিদের খাদ্য কম দেয়ার সব অভিযোগ মিথ্যা। বন্দিরা মিথ্যা কথা বলেছে।

সমাজসেবা অফিসার ও পরে তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা হয়েও কেন জেল সুপার পদে যোগ দিলেন জানতে চাইলে বলেন, এখানেই ভুল করেছি। মনে করেছিলাম এ পদে দ্রুত পদোন্নতি হয়।

নিজের শরীরে বন্দির ময়লা নিক্ষেপের বিষয়ে বলেন, জাবেদ আসলে পাগল।

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
September 2020
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
0Shares