এম,এ,রউফ।।
যদিও অভিযান না করার কারণ হিসেবে জনবল সংকটের অভাবকে দায়ি দায় সারলো কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর, সিলেট। আর নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, অর্থ সংকটের কারণে অনেক পরিবারই খাদ্য জোগানের জন্য শিশুদেরও কাজে লাগিয়ে দেয়। তাদের দাবি, অভিযানের পাশাপাশি সরকার মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করতে পারলে শিশুশ্রম কমে আসবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর সিলেট অফিসের তথ্যমতে, সিলেটের বিভিন্ন ওয়ার্কশপ ও বেকারিতেই বেশিরভাগ শিশুদের কাজে লাগানো হয়। প্রায় ৭০ শতাংশ শিশুশ্রম হয় ওই দুই প্রকারের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাকি ৩০ শতাংশ অন্যান্য প্রকারভেদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুদের কাজ করানো হচ্ছে
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর সিলেট অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে সিলেটের ৯টি বেকারি থেকে ৪৮ জন শিশুকে কাজ থেকে সরিয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর। তাদের মধ্যে রসমেলা ফুড প্রোডাক্টস থেকে ৪ জন, রাজমহল ফুড প্রোডাক্টস থেকে ৪ জন, কোয়ালিটি ফুডস থেকে ১০ জন, ওয়ান্ডার ফুড প্রোডাক্টস থেকে ৪ জন, ফিজা এন্ড কোং থেকে ১৩ জন, এইচ আর এম এগ্রো মার্কেটিং থেকে ৪ জন, জি বাংলা ফুড প্রোডাক্টস থেকে ৩ জন, রিয়েল ফুড প্রোডাক্টস থেকে ২ জন ও প্রতিষ্ঠান স্বাদ থেকে ৩ জন।
সূত্র অনুযায়ী, বেকারি থেকেও বেশি শিশু ওয়ার্কশপে কাজ করছে। চলতি অর্থবছরের সিলেটের ৪৮টি ওয়ার্কশপ থেকে ৬৭ জন শিশুকে কাজ থেকে অপসারণ করেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর সিলেট অফিস।
তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১২৩ জন শিশু বিভিন্ন কল-কারখানা কিংবা প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। যদিও বেসরকারি হিসেবে মতে এ সংখ্যা হাজারের মতো রয়েছে। এর মধ্যে গত দুই মাসে ৪৩ জন শিশুকে অপসারণ করা হয়েছে। আর ৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে মামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনটিই সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার
সিলেট নগরের বাগবাড়ি এলাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে গাড়ি মোছার কাজ করছে সবুজ মিয়া নামের এক শিশু। ১১ বছরের এই শিশু প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১১ ঘন্টা গাড়ি ধোয়া মোছার কাজ করে। বিনিময়ে গড়ে গাড়ি প্রতি ২০ টাকা মজুরি পায়। এর বাইরে ইচ্ছে হলে কেউ ১০-২০ টাকা বকশিস দেয়।
বিল্লাল জানায়, জন্মের তিন বছর পরেই বাবা মারা যান। মা অন্যের বাড়িতে ঝি’য়ের কাজ করতেন। দু’বছর ধরে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মা-ও ঘরবন্দি। তার ছোট আরও দুই বোন রয়েছে। সবমিলিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের থাকা-খাওয়ার খরচ যোগাতে হয় তার। এর মাঝে প্রতিদিন অসুস্থ মায়ের ১০০ টাকার ওষুধ লাগে। তাই বাধ্য হয়েই আট বছর বয়স থেকে পরিবারের হাল ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কথা হয় আরেক শিশু শ্রমিক রুমনের (১৩) সঙ্গে। নগরের লামাবাজার এলাকার একটি মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপে মেকানিকের কাজ করে সে। সে জানায়, ‘একশো টাকা রোজে সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করি। বাবা রিকশা চালক। তিন বছর হলো মা মারা গেছেন। তার ছোট দুই বোন রয়েছে। বাবা অন্যত্র বিয়ে করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ছোট বোনদের নিয়ে কানিশাইল এলাকায় একটি কলোনিতে ভাড়া থাকি। প্রতিদিন যা আয় করেন তা থেকে বাসা ভাড়া দেই, ঘরে চাউল কিনি।’
আইনে নিষেধ থাকলেও সারাদেশের মত কলকারখানা, দোকান-পাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ঝটিকা অভিযান হলে এসব শিশুদের বাদ দিয়ে পরবর্তীতে আবারও অন্য শিশুদের কাজে লাগান প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। যে বয়সে হাতে বই-খাতা-কলম নিয়ে পড়াশোনা করার কথা ছিল স্কুলে কিংবা মাদরাসায়। হাসি-খুশি ও আনন্দ-উল্লাসে বেড়ে ওঠার কথা ছিল। বিকেলে সহপাঠীদের মতো মাঠে খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা ছিলো কিন্তু ওদেরকেই সংসারের বোঝা কাঁধে নিতে হচ্ছে এই বয়সে।
তবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অর্থ সংকটের কারণে অনেক পরিবারই খাদ্য জোগানের জন্য শিশুদের কাজে লাগিয়ে দেয়। আমাদের উচিত শিশুদের শ্রমে না লাগানো। করোনা মহামারির কারণে সবার পারিবারিক আয় কমে গেছে। অনেকের কর্মক্ষেত্র বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারণে বেশিরভাগ লোকই অর্থ সংকটে ভুগছে। ফলে শিশুরাও কাজে লেগে গেছে।
এছাড়া অভিযানের পাশাপাশি সরকার মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করতে পারলে শিশুশ্রম কমে আসবে বলে তিনি জানান।
সিলেটে শিশুদের নিয়ে কাজ করে ‘ইচ্ছাপূরণ’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা রেশমা জান্নাতুল রুমা বলেন, প্রতিটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ গঠনের জন্য শিশু শ্রম নিষিদ্ধ রয়েছে। কিন্তু সমাজের এমন কোন ক্ষেত্র নাই যেখানে শিশুদের কাজ করতে দেখা যায় না। বিশেষ করে একবারে কম বয়সী শিশুরা বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোঁরা, গাড়ির ওয়ার্কশপ থেকে শুরু করে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কাজ করে থাকে। যার ফলে শিশুদের শারীরিক ক্ষতি এবং মানসিক চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
তিনি আরো বলেন, শিশুরা বাড়তি আয়ের লক্ষে তাদের বয়স অনুযায়ী বিপদ, ঝুঁকি, শোষণ ও আইনগত জটিলতা সম্মুখীন হয়ে নিজেকে নিয়জিত করে বিভিন্ন ঝুকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। এতে আমাদের আগামী প্রজন্ম দিন দিন বিপদের দিকে যাচ্ছে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর সিলেট অফিসের উপ-মহাপরিদর্শক তপন বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, সিলেটে প্রায় ৭০ শতাংশেই শিশুশ্রম হচ্ছে বেকারি ও ওয়ার্কশপগুলোতে। আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালাই। এদের মধ্যে কোনো শিশুকে কাজে দেখতে পেলে ওই প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ পাঠাই। যাতে করে শিশুদেরকে যাতে আর কাজে না লাগান। শিশুদেরকে অপসারণ করা না হলে আমরা পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
জনবল সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ১৭ জন পরিদর্শক থাকার কথা থাকলেও মাত্র ৫ জন দিয়েই আমরা পুরো জেলাটি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এতে করে অনেক সময় চাইলে আমরা অনেক জায়গায় অভিযান করতে পারি না। তাছাড়া প্রচলিত আইনেও ফারাক থাকায় আমরা সরাসরি অ্যাকশনে যেতে পারছিনা। তবে শিশুশ্রম রোধে আমরা সবসময় সচেষ্ট।