মৌলভীবাজারে ছোট ভাইয়ের হাতে ছাত্রদল নেতা খুন: উঠে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য”

  • আপডেট টাইম : August 11 2025, 10:50
  • 8 বার পঠিত
মৌলভীবাজারে ছোট ভাইয়ের হাতে ছাত্রদল নেতা খুন: উঠে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য”

 

মৌলভীবাজারে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন: টাকার ঝগড়া থেকে জমে থাকা ক্ষোভের করুণ পরিণতি

মৌলভীবাজারের শান্ত-নিরিবিলি গ্রাম সিদ্ধেশ্বরপুর। চারপাশে সবুজ ধানের ক্ষেতে ঘেরা এই গ্রাম হঠাৎই রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। এখানে ঘটে যায় এমন এক ঘটনা, যা পুরো এলাকাবাসীকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে—এক ভাইয়ের হাতে আরেক ভাইয়ের জীবন শেষ হয়ে যায়। নিহত যুবক আব্দুর রহিম রাফি ছিলেন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হিসেবে এলাকায় পরিচিত মুখ। আর হত্যাকারী? রাফির আপন ছোট ভাই।

 

তারিখ ৯ আগস্টের সকাল। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা কেউ বাইরে, কেউ কাজে ব্যস্ত। ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন রাফি। কিন্তু ছোট ভাই রানার (ছদ্মনাম) মনে তখন আগের রাতের অভিমান ও ক্ষোভ ফুঁসে উঠছে। আগের দিন রাত ৮টার দিকে সে বড় ভাইয়ের কাছে ৫০০ টাকা চেয়েছিল। টাকার বদলে রাফি তাকে তিরস্কার ও গালাগাল করেছিলেন বলে রানার অভিযোগ। সেই মুহূর্তেই তার মনে প্রতিশোধের বিষবীজ বপন হয়।

সকাল ৭টার দিকে রানার মা বাড়িতে ছিলেন না, আর রাফির ঘরের দরজা খোলা। সুযোগ বুঝে রানা খাটের নিচ থেকে ধারালো দা বের করে আনে। ঘুমন্ত ভাইয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একের পর এক কোপ দেয়। মুহূর্তের মধ্যে নিথর হয়ে যান রাফি। রক্তে ভিজে যায় বিছানা, মেঝে—রক্তে লাল হয়ে ওঠে পুরো ঘর।

অপরাধের পর যেন কিছুই হয়নি—এমন ভান করেছিল রানা। দা ধুয়ে খাটের নিচে রেখে দেয়, নিজের রক্তমাখা লুঙ্গিও ধুয়ে শুকাতে দেয়। তারপর স্বাভাবিকভাবে পরিবারের সঙ্গে আচরণ করতে থাকে, যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু হত্যার সেই ভয়াবহ দৃশ্য ঘরের চার দেয়ালে লুকিয়ে ছিল, যা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রকাশ পেতে শুরু করে।

 

ঘটনার খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে পৌঁছান মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) নোবেল চাকমা, শ্রীমঙ্গল সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান এবং কমলগঞ্জ থানার ওসি আবু আফর মো. মাহফুজুল কবির। তারা ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেন।

তাদের সন্দেহের তালিকায় প্রথমেই আসে পরিবারের সদস্যরা। এলাকাবাসীর বক্তব্য ও নিহতের স্ত্রীর দেওয়া তথ্য পুলিশের সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। এরপর একই দিনে রানা হেফাজতে আসে।

১০ আগস্ট সন্ধ্যায় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রানা সব খুলে বলে দেয়। জানায়, শুধু ৫০০ টাকা না দেওয়ার জন্যই নয়—এর পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ। চার বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই রাফি তাকে মাদ্রাসায় থাকার জন্য চাপ দিতেন, যা সে একদম পছন্দ করত না। ভাইয়ের বিয়ের বিষয়টিও তার মনে বিরক্তি জন্মায়। রাফি পরিবারের অমতে প্রেম করে বিয়ে করায় ভাবি ও শাশুড়ির সঙ্গে দেবরের দূরত্ব তৈরি হয়। এই পারিবারিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে আর্থিক বিষয় মিলে রানা ক্রমশ রাফির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

তার কথায়, “আমাকে মাদ্রাসায় রাখতে চাইত, বকাঝকা করত, আর আমার ইচ্ছাকে পাত্তা দিত না। সেই রাগ জমে ছিল অনেক দিন ধরে।”

রানার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পুলিশ হত্যার অস্ত্র দা এবং রক্তমাখা লুঙ্গি উদ্ধার করে। এই প্রমাণ আদালতে শক্ত ভিত্তি হিসেবে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছে তদন্তকারী কর্মকর্তা।

প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশের বক্তব্য

১১ আগস্ট দুপুরে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা জানান, “এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। শুধু তাৎক্ষণিক রাগ নয়, পূর্বের পারিবারিক টানাপোড়েন ও ব্যক্তিগত ক্ষোভও এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।”

পুলিশ আরও জানায়, এ ঘটনায় নিহতের মা মনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে কমলগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।

ঘটনার পর থেকেই সিদ্ধেশ্বরপুর গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না—এক ভাইয়ের হাতে অন্য ভাই খুন হতে পারে। প্রতিবেশী মকবুল হোসেন বলেন, “রাফি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল, হাসিখুশি ছেলে। এমন পরিণতি হবে—ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।”

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা কিশোর বয়সে মারাত্মক    পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ছোটখাটো আর্থিক দ্বন্দ্ব বড় হয়ে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, যদি সেটি দীর্ঘদিনের ক্ষোভের সঙ্গে মিশে যায়।

মৌলভীবাজারের এই ঘটনা শুধু একটি খুন নয়—এটি পারিবারিক সম্পর্কে অবনতির এক নির্মম উদাহরণ। যেখানে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও বোঝাপড়ার জায়গা দখল করে নেয় অভিমান, ক্ষোভ আর রাগ। আর সেই রাগ এক সময় রক্তাক্ত পরিণতি ডেকে আনে।

পুলিশ মামলাটি আদালতে পেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে গ্রামবাসী এখনও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে—কীভাবে এত অল্প বয়সী একজন ছেলে এমন নির্মম অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে?

 

0Shares
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
August 2025
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
0Shares