শোকাবহ আগষ্ট মাসে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরবিারসহ সকল শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন করছি ।
মোঃ মোস্তফা মিয়া
বাঙালি জাতি সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি একটি মিশ্রিত জাতি এবং এ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিতম মানবগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বহু জাতি বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছে, অনেকে আবার বেরিয়েও গেছে, তবে পেছনে রেখে গেছে তাদের আগমনের অকাট্য প্রমাণ। বৃহত্তর বাঙালির রক্তে মিশ্রিত আছে বহু এবং বিচিত্র সব নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। দীর্ঘকাল বিভিন্ন জন ও কোমে বিভক্ত হয়ে এ আদি মানুষেরা বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেছে, এবং একে অপরের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে শতকের পর শতকব্যাপী। জাতিতাত্তি¡ক নৃবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর চারটি প্রধান নরগোষ্ঠীর প্রতিটির কোনো না কোনো শাখার আগমন ঘটেছে বাংলায়। নরগোষ্ঠীগুলি হলো নিগ্রীয়, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও অষ্ট্রেলীয়। মনে করা হয় যে, বাংলার প্রাচীন জনগুলির মধ্যে অষ্ট্রিক ভাষীরাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সাঁওতাল, বাঁশফোড়, রাজবংশী প্রভৃতি আদি অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই আদি জনগোষ্ঠীগুলি দ্বারা নির্মিত সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে আর্যদের আগমনের পর। বাংলাদেশের জনপ্রবাহে মঙ্গোলীয় রক্তেরও পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙালির রক্তে নতুন করে মিশ্রন ঘটল পারস্য-তুর্কিস্তানের শক জাতির আগমনের ফলে। বাঙালি রক্তে বিদেশি মিশ্রন প্রক্রিয়া ঐতিহাসিককালেও সুস্পষ্ট। ঐতিহাসিকযুগে আমরা দেখি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং ভারতের বাহির থেকে আসা বিভিন্ন অভিযাত্রী নরগোষ্ঠী বাঙালি জাতি নির্মাণে অবদান রাখতে। গুপ্ত, সেন, বর্মণ, কম্বেজাখ্য, খড়গ, তুর্কি, আফগান, মুগল, পুর্তুগিজ, ইংরেজ, আর্মেনীয় প্রভৃতি বহিরাগত জাতি শাসন করেছে বঙ্গ অঞ্চল এবং রেখে গেছে তাদের রক্তের ধারা। এমনকি পাকিস্তান যুগেও আমরা দেখি রক্ত মিশ্রণে চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এ শংকরত্ব আরো বেগবান হচ্ছে। এক কথায় বাঙালি একটি শংকর জাতি।
বাঙালি জাতি পরিচয়ের ঐতিহাসিক যুগ শুরু হয় গুপ্তযুগ (৩২০ খ্রি.- ৬৫০ খ্রি.) থেকে এবং এ যুগেই প্রথম ক্ষুদ্র রাজ্যপুঞ্জগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় বিশাল রাজ্য। যেমন গুপ্তদের সাম্রাজ্যিক ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ক্ষুদ্র রাজ্যের বদলে বৃহৎ রাজ্য যেমন পূর্ব ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গরাজ্য ও উত্তরাঞ্চলের গৌড় রাজ্য। বৃহৎ বঙ্গের প্রথম এবং ঐতিহাসিকভাবে সুনির্দিষ্ট এবং শক্তিশালী শাসক শশাঙ্ক (খ্রিস্টপূর্ব আনু ৬০০ খ্রি.-৬২৫ খ্রি.) তাঁর দক্ষ শাসনের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন থেকেই বাঙালি জাতিসত্ত্বার যাত্রা শুরু হয় এবং পাল ও সেন আমলে এসে সে সত্ত্বা আরো বিকশিত হয়ে বাঙালি জাতির শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে। সে ভিত্তির ওপরই স্থাপিত বাংলায় সুলতানি রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের নাম দেয়া হয় বাঙ্গালাহ বা বাংলা এবং বাংলা রাষ্ট্রের অধিবাসীরা পরিচিত হয় বাঙালিয়া বা বাঙালি নামে। ড. মোহাম্মদ এলামূল হক এর গবেষণা থেকে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বা সম্পর্কে জানাযায় নূহ (আঃ) তৃতীয় পুত্র ইয়াফেস এর অন্যতম বংশধর হিন্দ এর নামানুসারে হিন্দুস্থানের নাম হয় এবং হিন্দ এর বহু পুত্রের মধ্যে একজনের নাম ছিলো বং এবং বং উপমহাদেশের যে অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন সেই অঞ্চলের নাম হয় বং। পরে বং থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে আজকের বাংলাদেশ নাম হয়।ড. মোহাম্মদ এলামূল হক স্যারের এই গবেষণার সাথে উপমহাদেশের ইসলামী পন্ডিতগণও একমত পোষন করেন।
সুলতানি আমলেই আবার সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য তৈরি হয় একটি সাধারণ ভাষা। নাম বাংলা ভাষা। শতকের পর শতক ব্যাপী বিকশিত হয়ে সুলতানি আমলে এসে আমরা পাই বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা। এ পর্বে বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতিতে যুক্ত হয় নতুন নৃগোষ্ঠী তুর্কি-আফগান-মধ্যএশীয় উপাদান। সরকারি পর্যায়ে বাংলা ভাষার পাশাপাশি প্রবর্তিত হয় ফার্সি ভাষা। এ উপাদান আরো সমৃদ্ধি লাভ করে মোগল আমলে (১৫৭৫-১৭১৭)। বাঙালি জাতি বা বাঙ্গালি জাতি একটি সংকর জাতি ও তারা দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী আদিতম মানবগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে একটি। প্রায় ১৫০০ বছর আগে আর্য-অনার্য মিশ্রিত প্রাকৃত ভাষা থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা ভাষা এবং ব্রাহ্মী লিপি থেকে সিদ্ধম লিপির মাধ্যমে আধুনিক বাংলা লিপির সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীকালে অষ্ট্রিক ও নিগ্রিটো জাতির মানুষ এসে মিশেছে। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়খন্ড, আসাম, ত্রিপুরা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বাইরেও, মধ্যপ্রাচ্য, জাপান, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি সহ সারাবিশ্বে অনেক প্রবাসী বাঙালি আছেন এবং বাঙ্গলীর এ ধারা অব্যাহতভাবে বিকশিত হচ্ছে। বাঙ্গালী জাতিস্বত্ত্বা ও বাংলা ভাষার দাবীকে কেন্দ্র করে স্বাধীকার আন্দোলন সৃষ্টি হয় এবং এর মাধ্যমে স্বাধীনতার চেতনা প্রচন্ডভাবে বিকশিত হয়। পরিশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাজনীতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্বের ইতিহাসে স্বাধীন ও স্বার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি হয় এবং বাঙ্গালী জাতিস্বত্ত্বা প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করতে সক্ষম হয়।
মুগল রাষ্ট্র কাঠামোয় বাংলাদেশ একটি সুবাহ বা প্রদেশ হলেও বাংলার সুবাদারেরা এর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যে যতœবান ছিলেন। এ সময়ে প্রচলি হয় বাঙালির প্রধান উৎসবাদি। বাংলা সাল, বাংলা মাসের নাম ও পহেলা বৈশাখএ নববর্ষ উৎসব মুগলদের অবদান। বাঙালি সমাজে প্রবর্তিত নানা উৎসব, নানা খাদ্য, নানা বেশভূষা যা বাঙালিত্বকে আরো বর্ণাঢ্য করে তোলে। পান, তামাক, পানীয়, জলসা বা আড্ডা প্রভৃতি মুগল শাসনের বিশেষ অবদান। এ সবের প্রভাব পড়ে বাংলা সাহিত্যে। সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদ ও এতদসংক্র্ন্তা সাহিত্য ও লোকাচার বাঙালি মননকে করে তোলে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যা সাম্প্রদায়িক সহনশীলতা-সহযোগিতাকে শক্তিশালী করে। মুগল রাজনীতি ও দরবার সংস্কৃতি ছিল সব ধর্ম ও মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশিলতা। ঢাকা ও পরবর্তীকালে মুগল দরবারের আমীর-ওমরাদের অর্ধেকই ছিলেন হিন্দু। নবাব সুজাউদ্দিন খান (১৭২৭-১৭৩৯) এর দরবারে হিন্দু আমীররা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সমকালীন প্রায় সব বড় ব্যবসায়ী পরিবার যারা নবাবি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিপূর্ণ ছিলেন তারা প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। রাজনৈতিকভাবে এসব বৈশিষ্ট্য বলে দেয় যে, সমকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক বিবেচনা ছিল না। বিগত কয়েক শত বছর ধরে অনেকটা অজ্ঞাতসারেই যে বাঙালি জাতি নির্মিত হচ্ছিল তাতে ধর্মীয় বিবেচনা কখনো আসেনি। এমনকি ব্রিটিশ আমলের শেষ দশক পর্যন্ত জাতি নির্মাণে ধর্ম দেখা যায় না। ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সমর্থন আদায়ের জন্য তাদের এ মর্মে জাগ্রহ করা হচ্ছিল যে, বাংলা ভাগ হলে পূর্ববঙ্গের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত মুসলমান সম্প্রদায় অভূতপূর্ব সুযোগ সুবিধা লাভ করবে। সরকারের প্ররোচনায়ই ঢাকায় সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলো সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ। এরই প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব জেগে উঠে। অযৌক্তিকভাবে নতুন প্রদেশ ইস্ট বেঙ্গল ও আসাম প্রদেশের বিরুদ্ধে কলকাতা ভিত্তিক হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণি এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে শেষ পর্যন্ত সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য করা হয়।
ব্রিটিশপূর্ব যুগে সরকার কখনো জনগণকে ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত করে শাসন করার প্রয়াস পায়নি। এ কৌশল ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগের। ১৯০৯, ১৯১৯ ও ১৯৩৫ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্টগুলি সম্প্রদায় ভিত্তিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এবং এরই ভিত্তিতে গঠিত হয় পরবর্তী সময়ের সরকারগুলি। এর ফলে দেশে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সম্পর্কে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ প্রাধান্য পায়। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রণোদনায়ই ১৯৪০ সালে ভারতে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উঠে এবং ঐ দাবির ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদতত্ত্ব টেকসই প্রমাণিত হয়নি। উর্দু এবং বাংলা উভয় ভাষাই সুলতানি ও মুগল শাসনামলে বিকশিত হয়- উর্দু উত্তর ভারতে এবং বাংলা বঙ্গদেশে। কিন্তু বাংলাকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শাসকশ্রেণি হিন্দুর ভাষা হিসেবে গণ্য করে কেবল উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলা ভাষী পূর্ব পাকিস্তানীরা এর প্রতিবাদ জানায় এবং বাংলাকে সমমর্যাদা দেবার জন্য আন্দোলন করে। এ আন্দোলনে পাকিস্তানীদের নিকট স্পষ্ট করা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা জাতি হিসেবে বাঙালি এবং বাংলা তাদের মাতৃভাষা। এখান থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত। এরই চূড়ান্ত ফল হল বাঙালি জাতি স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শখে মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে লাভ করল ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ।
বিশ্বের এমন কিছু দেশ আছে যাদের স্বাধীনতার জন্য এক একজন মহীরূহসদৃশ দেশনেতার অবদান সর্বাধিক মর্যাদা ও স্বীকৃতি পায়। এই ব্যক্তিই দেশের স্থপতিস্বরূপে নন্দিত হন। যেমন ভারতের মোহন দাস করম চাঁদ মহাত্না গান্ধী, পাকিস্তানের কায়দে-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য শেখ মুজিবের অবদান যে সবচাইতে বেশি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইনি বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা। দেশ ও জাতি গঠনের ক্ষেত্রে আরও কতিপয় বড় মাপের নেতার নাম আমরা জানি, যেমন শেরে বাংলা একে এম ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ। এরা জনদরদি নেতা ছিলেন এবং বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এরাও উল্লেখযোগ্য মূখ্য ভ‚মিকা পালন করেছেন। শেখ মুজিব এদের স্নেহাশ্রয়ে রাজনৈতিক কর্মীরূপে দীক্ষা নেন কিন্তু পরে অসামান্য নেতৃত্বগুন, সাংগঠনিক দক্ষতা, সাহস, দেশপ্রেম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার জন্য তিনি বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে ওঠেন। তাকে ঘিরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা কামনা সত্য হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান। তিনি পিতামাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। ১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি আইএ পড়তে যান কলকাতায়। কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৪ সালে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করেন। ছাত্রজীবনেই শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিমনস্ক হয়ে ওঠেন। ঔপনিবেশিক আমলের শেষ পর্যায়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন দেশীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মতৎপরতায় অসংখ্য ছাত্র ও যুবক সাংগঠনিক কাজে এগিয়ে আসে। শেখ মুজিবও রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হন এবং অচিরেই নেতৃত্বপদে আসীন হন। তিনি ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদকও ছিলেন। পাকিস্তান হবার পর তার কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্রস্থল হয় ঢাকা। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্থপতি। তিনি পাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। সেজন্য তিনি পাকিস্তানি শাসকের বিষণ রোষাণলে পরে যান। তাকে নানা জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তাকে জেলে প্রেরণ করা হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক হন। ১৯৫৪ সালে প্রদেশিক পরিষদে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ের মূল্যে তার সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় ঘটে। শেখ মুজিবুর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় অন্তর্র্র্ভূক্ত হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে দেশে অন্যায়মূলক ভাবে গভর্ণর শাসন জারি করা হয় এবং শেখ মুজিবকেও আবার জেলে যেতে হয়। জীবনে কতবার যে কারাবাস করেছেন তার হিসেব দেয়াও মুশকিল।
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় হল আইয়ুব খানের এক দশকের শাসনকাল। এই সময়েই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার সত্যিকারের উত্থান ঘটে। ১৯৫৮ সালে অক্টোবর মাসে মার্শাল ল জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খান পাকিস্তানের সর্বময় কর্তা হয়ে বসেন। তার আমলের সকল গণবিরুধী বিধিব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন শেখ মুজিব। ১৯৬৪ সালে রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়। নতুন সময়ের আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোও পুনঃঘটিত হয়। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আসীন হন। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা’ প্রস্তাব লাহোরে উত্থাপন করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার ও স্বায়ত্বশাসনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের অশুভ হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বাচাঁর এটিই ছিল মূলমন্ত্র। শেখ মুজিবুরের রাজনৈতিক কর্মসূচি ও জনপ্রিয়তা দেখে পাকিস্তানের শাসককূল ভীত হয়ে পড়ে। তারা তাকে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে কারারুদ্ধ করে রাখে। কিন্তু এতে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। ১৯৬৯ এর প্রথম থেকেই আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ বাড়তে থাকে এবং ক্রমশ তা গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবকে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। শেখ মুজিব জননন্দিত নেতা, সেজন্য তিনি ১৯৬৯ সালে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৬৯-এর ২৫এ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তান সেনা বাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খান মার্শাল ল জারি করেন এবং আইয়ুব খানের স্থলে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। তিনি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ১৯৭০-এর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন এটা ছিল নিশ্চিত। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা ভুট্রোর পরামর্শে ইয়াহিয়া খান ১৯৭১-এর ১লা মার্চে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ফলে সারা পূর্ব পাকিস্তান বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। দেশে শুরু হয় তীব্র অসহযোগ আন্দোলন। ৭ই মার্চে শেখ মুজিব রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক অবিস্মরণীয় ভাষণ দেন এবং ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এদিকে আলোচনার নামে নানা প্রহসন চলতে থাকে। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং ২৫এ মার্চ রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেই রাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বন্দি করে রাখা হয়। এদিকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা হানাদার বাহিনীর অত্যাচার রুখতে সংঘবদ্ধ হতে থাকে। ২৬-এ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। শেখ মুজিবের নামে মুক্তিযোদ্ধারা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরে। শেখ মুজিবই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রেরনা। একাত্তরের সতেরই এপ্রিল মুজিবনগরে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতিও ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার দেশে ফিরে শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। শেখ মুজিব তখনও পাকিস্তানের কারাগারে। কিন্তু বিশ্ব জনমতের চাপে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিব দেশে ফিরে আসেন ১৯৭২-এর ১০ই জানুয়ারি। যুদ্ধবিদ্ধস্থ স্বদেশে ফিরে এসে তিনি রাষ্ট্রপতি হন। দেশের তখন চরম দুর্দশা। ভগ্ন, দেশ অর্থভান্ডার শুন্য, শিল্প কারখানা, যোগাযোগ সবই বিদ্ধস্ত। এ দুরবস্থা থেকে দেশকে পর্যায়ক্রমে তিনি টেনে তুলছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধেও গোপনে গোপনে অশুভ চক্র গড়ে ওঠে। এই চক্র সেনাবাহিনীর একটা বিপদগামী অংশ ছিল এবং তারা মদদ দিয়ে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবকে তার বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করে।
শেখ মুজিব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি- এটিই তার সর্বোত্তম কীর্তি। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় যে শেখ মুজিবের অবিচলিত সাহসী নেতৃত্বের ফল সে কথা একশভাগ সত্য। শেখ মুজিব তৃতীয় বিশ্বের বরেণ্য নেতা। গণতন্ত্রের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন এবং নির্যাতনও সহ্য করেছেন। একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর অবদানকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছিলেন। এটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানের আসন যে অনন্য মর্যাদার সেটি কোনোভাবেই বিস্মৃত হওয়া চলে না। বঙ্গবন্ধুর সমস্ত আন্দোলনের একটিই উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা। বাঙ্গালী জাতি স্বত্ত্বার উপর যখনই আঘাত এসেছে তখনই বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ মুখর হয়ে সেই আঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে , ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন , আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন ,১৯৭০ এর নির্বাচন যখনই বাঙ্গালীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সামনে এসেছে তিনি পাকিস্তানী সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বজ্র কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।এমনকি আমরা দেখেছি তৎকালীন তথাকথিত গনতন্ত্রকামী নেতার পলিসি যখন ছিল “ ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব পলিসি” অথবা যখন ঠুনকো অজুহাতে বাঙ্গালীর ভোটের দাবি অর্জনের লড়াইয়ে সামিল হলেন না, সেই সময়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন হিমালয়ের মত অবিচল। ১৯৭০ এর নির্বাচনে জয় লাভের পর যখন পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে টাল বাহানা শুরুকরে তখন তিনি তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণেও জাতীয়তাবাদকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি বলেন “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।” অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে উদ্ভাসিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ইতিহাসে যার নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং বাঙালি জাতির জনক। ‘বঙ্গবন্ধু’ ও বাংলাদেশ আজ সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে এক অভিন্ন নাম। তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়েও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে ছিলেন অবিচল। মৃত্যুভয় ও তাকে তার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তার অবস্থান থেকে এক বিন্দু নড়াতে পারেনি ।একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনিই ছিলেন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা এবং জাতীয়তাবাদের আলোকে উদ্ভাসিত একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর জন্মশতবর্ষে তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং রুহের মাগফেরাত করছি।
লেখকঃ অধ্যক্ষ ও কলামস্টি ।